×

ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরে বেপরোয়া চোরাই সিন্ডিকেটে

মোহাম্মদ আলম : গাজীপুরে ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের সালনা থেকে হোতাপাড়া পর্যন্ত দুইপাশে চোরাই তেল বেচা-কেনার রমরমা কারবার। প্রায় ২৫টি আখড়ায় মাসে কয়েক কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন চলে। আর দিনের পর দিন লোকসান গুনছে পরিবহন ব্যবসায়ীরা। একইভাবে অন্যান্য চোরাই পণ্য যেমন- কারখানার সুতা, কাপড়, গৃহস্থালী সামগ্রীসহ, যন্ত্রাংশও এখানে অবাধে বেচাকেনা চলে। দীর্ঘদিন মাসোহারায় চলা এই চোরাকারবার বর্তমানে পুলিশের টহলকে প্রতিদিন বখরা দিয়ে চলছে বলে অভিযোগ।

তবে বাধ সেধেছেন জিএমপির বর্তমান ওসি। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে গাজীপুর সদর থানার বর্তমান ওসিকে ম্যানেজ করতে চোরাকারবারি সকল সদস্যর কাছ থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকাও তুলা হয়েছে। এই টাকা মাসোহারা হিসাবে দেয়ার কথা। দীর্ঘদিন যাবৎ এভাবেই চলছে। ‘সিন্ডিকেটের হোতা জামানের মাধ্যমে গাজীপুর সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ রফিকুল ইসলামকে ম্যানেজের চেষ্টা করেও সুবিধা করতে পারেনি বলে জানা গেছে। আর ওসির ভাষ্য, চোরাই দোকান চলার কথা তিনিও শুনেছেন। শিঘ্রই সেখানে অভিযান চালানো হবে জানালেন।

গাজীপুর জেলা ট্রান্সপোর্ট ঠিকাদার মালিক সামিতির সাধারণ সম্পাদক এবং শিলা ট্রান্সপোর্ট এজেন্সির মালিক দ্বীন মোহাম্মদ নীল মিয়া জানান, চোরাই সিন্ডিকেটের দৌড়াত্মে ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীরা অনেকেই পথের ফকির হয়েছে। কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও গাড়ির মালিক লাভের মুখ দেখে না। অথচ সামান্য কয়েকটি টাকার জন্য গাড়ির চালকরা চুরি করে তেল বেচে, আর এইসব চোরাকারবারিরা বছর না ঘুরতেই কোটিপতি হচ্ছে। লিভার ব্রাদার্সের ২০ টন হুইল পাউডার সহ তার একটি ট্রাক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। অনেক খোঁজাখোজির পর চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে হুইল পাউডার উদ্ধার হয়। তবে প্রায় ২০ লাখ টাকার ট্রাকটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই চোরাই সিন্ডিকেট দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়ক এবং সারাদেশে জাল বিস্তার করেছে বলে তিনি জানান।

জানা গেছে, আমানত শাহ গ্রুপের শাড়ি ও লুঙ্গি বোঝাই একটি কাভার্ড ভ্যান টঙ্গী থেকে ছিনতাই হয়। পরে মালামালসহ খিলগাও থেকে পুলিশ সেটি উদ্ধার করে। তবে ছিনতাই চক্রের সদস্যরা ধরা ছোয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।

সোহেল অল্পদিন হলো চোরাকারবারের সাথে জড়িত হয়েছে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে নিজেকে সাধু সাজানোর ভান করে। অকাতরে বলে যায় এই চোরাই ব্যবসার আদ্যোপান্ত। সে জানায়, রাতদিন ২৪ ঘন্টাই এসব চোরাই খুপরি খোলা থাকে। দিনরাত সাধারণত গাড়ির চালকরা বাস, ট্রাক বা কার্ভাড ভ্যান থামিয়ে তেল (চুরি) বিক্রি করে। ফিড কোম্পানীর ভুট্টা এবং ফিডমিলও নিয়মিত বেচাকেনা হয়। তবে তার চেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে সারাদেশ থেকে চুরি বা ছিনতাই হওয়া ট্রাক কার্ভাড ভ্যানের মালামাল জামান-মাসুদ-আয়নাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেচাকেনা চলে।

চুরির উপর বাটপারি : সোহেলসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি লিটার ডিজেল চালকের কাছ থেকে কিনতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা খরচ। আর বিক্রি ৬৩ টাকা। তাহলে প্রশ্ন লিটারে মাত্র ৩ টাকা লাভের জন্য কেন এত রিস্ক নেয় ? গাড়ির চালক চুরি করে তেল বিক্রির উদ্দেশে এলে চোরাই সিন্ডিকেট চুরির উপর বাটপারি করে। ট্যাংকি থেকে তেল নামানোর সময় ২ থেকে ৩ লিটার বেশী নিয়ে নেয়। অর্থাৎ ১০ লিটারের যায়গায় ১৩ লিটার। এতে লাভ প্রায় দ্বিগুন হয়। একইভাবে ভুট্টা, ফিডমিল, কারখানার কাপড়, স্পিনিং মিলের সুতা, সয়াবিন তেলসহ নানান চোরাই পণ্য এখানে কেনাবেচা হয়। আর চুরি বা ছিনতাই হওয়া ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান মালামালসহই কেনা-বেচা চলে।

কারা আছে চোরাই সিন্ডিকেটে : মহাসড়কের এই ভয়ংকর চোরাই সিন্ডিকেটের মালামাল ৪টি হাত বদল হয়। প্রথম হাত হচ্ছে গাড়ির চালক। বাস, ট্রাক বা কাভার্ড ভ্যান মালিকের অগোচরে চালক নিয়মিত তেল বিক্রি করে। প্রথম হাতের অপর সংগ্রাহক হচ্ছে মালামালসহ গাড়ি ছিনতাইকারী চক্র। এরা সারাদেশ থেকে আসে। দ্বিতীয় হাত হিসাবে মহাসড়কের পাশে চোরাই সিন্ডিকেটের আখড়া মালিকরা ২৪ ঘন্টা এসব চোরাই মালামাল অর্ধেক কখনো কখনো আরো কমে কিনে নেয়। তৃতীয় ধাপে পাইকার। আখড়া থেকে ৮/১০ জন পাইকার তেল বা অন্যান্য পণ্য সংগ্রহ করে। চতুর্থ ও শেষ ধাপের সিন্ডিকেট সদস্যরা সারাদেশে চোরাই পণ্য বিক্রির খুচরা দোকানদার। পাইকারের মাধ্যমে এসব চোরাই তেল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। শেষধাপে গ্রামাঞ্চলে চোরাই পণ্য বা তেলের নির্দ্দিষ্ট দোকানে সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া শিল্প কারখানায় জেনারেটর বা ব্রয়লার চালানোর তেল হিসাবেও এসব চোরাই তেল সাপ্লাই দেয়া হয় বলে জানা গেছে। অপরদিকে কারখানার কাপড়, পোশাক বা সুতা জাতীয় চোরাই পণ্য কেনা বেচার চক্রও রয়েছে।

মাসে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন : সালনা থেকে হোতাপাড়া পর্যন্ত এলাকায় প্রায় ২৫ টি চোরাই পণ্য বেচা-কেনার খুপরি। এলাকাটি গাজীপুর সদর এবং জয়দেবপুর থানার আওতাধীন। এক খুপরিতে কম করে হলেও ২ থেকে ৩ ড্রাম তেল জমে। সেই হিসাবে দিনে প্রায় ৭৫ ড্রাম তেল চুরি হয়। এক ড্রামে ২২০ লিটার ডিজেল থাকে। প্রতি লিটার ৬৫ টাকা দরে এক ড্রামের মূল্য ১৪ হাজার ৩০০ টাকা। ৭৫ ড্রামের দাম পরে ১০ লাখ টাকার উপর। এই হিসাবে শুধুমাত্র ডিজেলের জন্য। সয়াবিন, ভুট্টা বা ফিডমিল চুরি হচ্ছে নিয়মিত। তাছাড়া প্রতিদিনি রাতে ১/২টি ট্রাক/কাভার্ড ভ্যান ভর্তি চোরাই মালামাল বেচা-কেনা চলে। সেই হিসাবে সক্রিয় চোরাই সিন্ডিকেট মাসে কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য করে।

মহাসড়কে চোরাই সিন্ডিকেট সদস্যরা : পোড়াবাড়ি এলাকায় বরিশাইল্যা জামান, আয়নাল এবং হোতাপাড়ায় মাসুদ হচ্ছে সিন্ডিকেটের মূল হোতা। এদের সহযোগী হিসাবে কাজ করে সিন্ডিকেটের সদস্য চালক, পাইকার। তাছাড়া সেলিম, রাজ্জাক, বাদশা, আবুল কাশেম, ফিরোজসহ প্রায় ২৫ জনের একটি চক্র সক্রিয়ভাবে আখড়া বসিয়েছে। তাছাড়া টঙ্গীর চেরাগআলী এলাকায় রুবেল তেল চোরাকারবারী। আর প্রতিটি আখড়ায় সহযোগী হিসাবে ৫০০ টাকা রোজীতে খাটে করে আরো কয়েকজন যুবক। এরা গাড়ি থামানো, পাহাড়া দেয়ার কাজ করে।

সরজমিনে একদিন : বিভিন্ন সূত্রে চোরাই সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে পেরে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এই প্রতিবেদক গত ১৪ সেপ্টেম্বর সারাদিন সালনা থেকে হোতাপাড়া পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। বেলা ১২টার দিকে পোড়াবাড়ি এলাকায় মহাসড়কের পূর্বপাশে রাজ্জাকের আখড়া থেকে একটি পিকাআপ ভ্যানে ৫টি তেলের ড্রাম উঠাতে দেখা যায়। ঘটনার ভিডিও ধারন করতে গেলে আখড়ার কর্মচারি বাধা দেয়। তার সাথে পিকাআপের চালক, পাইকার ও দোকানের মালিকও ভিডিও ধারনে বাধা দেবার চেষ্টা করে। তবে প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে ভিডিও ধারন অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে পাইকার পরে যোগাযোগের আশ^াস দিয়ে পিকআপ নিয়ে সটকে পরে। আর আখড়ার রাজ্জাক ও তার কর্মচারি সব ফেলে পালায়।
বেলা ১টার দিকে পোড়াবাড়ি এলাকায় আবুল কাশেমের আখড়ায় একজন যুবক একটি তেল ভরা ড্রাম লুকাচ্ছিলো। প্রতিবেদক গাড়ি থামিয়ে ভিডিও ধারন শুরু করতেই দৌড়ে পালায়।
বেলা ২টায় ফের রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তা। সেখানে কথা হয় চোরা কারবারি মোঃ সোহেলের সাথে। নিজেকে সাধু সাজাতে সব কথা বলতে রাজি হয়। তার কাছ থেকে আদ্যোপান্ত অনেক কিছু নিশ্চিত হওয়া গেছে।

ইতমধ্যে সাংবাদিক আসার খবর সিন্ডিকেটের সবার কাছে পৌছে যায়। আধাঘন্টা অপেক্ষার পর আড়াইটার দিকে এই প্রতিবেদক হোতাপাড়ার উদ্দেশে রওনা হয়। শুরুতে উল্লেখিত জামানের আখড়ায় একটি কার্ভাড ভ্যান(নম্বর ঢাকা মেট্রো-ট ১১-৮৪৮৫) থেকে তখন তেল চুরি চলছিলো। কাভার্ড ভ্যানের তেলের ট্যাংকির নীচে স্ক্রু খোলে একটি খোলা ড্রামে তেল নামানো হচ্ছে। আরএসকে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর কাভার্ড ভ্যানের চালক আনিছ(ছদ্মনাম) ১০ লিটার ডিজেল ৬০ টাকা দরে বিক্রি করেছে। প্রতিবেদক ঘটনার ভিডিও ধারণ করে। চোরাকারবারি জামানের কর্মচারি ভিডিও ধারনে বাধা দিতে চেষ্টা করেও সফল হয়নি। ততক্ষনে সিন্ডিকেটের কয়েকজন সদস্য সেখানে হাজির হয়। সিন্ডিকেটের সদস্যরা জামানের কর্মচারীকে গালাগাল করে। ‘ওই শালার– ! তর মালিক বরিশাইল্যা না পুলিশ ম্যানেজ করছে। সবার কাছ থিকা ট্যাকা তুলছে। অহন আবার এইডা কি?’’

সেখান থেকে পোড়াবাড়ি এলাকায় তালুকদার সিএনজির পাশে আয়নালের আখড়ায় একটি কাভার্ড ভ্যান বের হতে দেখা যায়। কাভার্ড ভ্যান থামিয়ে চালকের কাছ থেকে জানা যায়, অভিযান চলছে তাই আজ তেল কিনবে না। আখড়ার ভিতরে আরো একটি কাভার্ড ভ্যান দেখা যায়। সেটি থেকে ভুট্টা নামানো হয়েছে। সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়েই আয়নাল তার আখড়ার ঝাপ বন্ধ করে।
আয়নালের কাছে চোরা কারবারের কথা জানতে চাওয়া হয়। আয়নালের ভাষ্য, প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই সে ব্যবসা করে। তাছাড়া তেল ব্যবসার একটি ট্রেড লাইসেন্স আছেও বলেও জানায়। তবে কোনভাবেই আখড়ার ঝাপ খুলতে রাজি হয়নি।
বিকেল ৩টার পর হোতাপাড়ায় মাসুদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। যাচাই করার উদ্দেশে প্রতিবেদক তাকে ৩ ড্রাম চোরাই তেল বিক্রির প্রস্তাব করে। মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে মাসুদ তৎক্ষনাত তেল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করে। হোতাপাড়া নিউ বিলাশ হোটেলের পাশে তার দোকানে যেতে বলে। তবে ইতমধ্যে সাংবাদিক আসার খবরও তার কানেও পৌছে। অগত্যা সব বন্ধ করে সটকে পরে। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোন সারা পাওয়া যায়নি।

সিন্ডিকেট হোতা চোরা কারবারি জামানের সাথে মুঠোফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি কর্মচারি পাঠিয়ে অনুরোধ করেন যাতে সংবাদ প্রকাশ না হয়। তবে জামান কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে জয়দেবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মোঃ মাহতাব উদ্দিন বলেন, দ্রুত এব্যপারে ব্যবস্থা নিবেন।

ইতিপূর্বেও চোরাই সিন্ডিকেটের এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানিয়ে জিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার(অপরাধ) মোঃ জাকির হোসেন বলেন, এই চোরাই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ভবিষ্যতে যাতে আর এ ধরনের কাজে সম্পৃক্ত হবার চেষ্টা না করে।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *