×

হাড়ানো ইছামতির খোঁজে

শতাব্দী আলম  : ‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপরে একটি শিশির বিন্দু।’ ইছামতির দিকে তাকালে রবি ঠাকুরের কবিতার কথাগুলো হৃদয়ে শুলের মতো বিঁধে। ইছামতি একটি নদীর নাম। কূল উপচানো জল আর নেই। চোখের সামনে নদীও কেমন হাড়িয়ে যাচ্ছে। আমার শিশু-শৈশবের চঞ্চল দিনগুলি ইছামতির জলে দাপিয়ে ঝাপিয়ে কেটেছে। তখন ইছামতিও ছিল খরস্রোতা অথচ শান্ত-প্রাণবন্ত নদী। বাদাম তোলা ধানি নৌকা, কলাকোপা বা দাউদপুরের নৌকা বাইচ, শীতকালে নদী পারের ঘুড়ি উড়ানো এসব মনে হলে এখনো কেমন চনমনে লাগে। আজকের শিশুর কাছে তা কেবলই গল্পের মতো মনে হবে। কারণ আমাদের অদূরদর্শিতার কারনে ইছামতির সেই চঞ্চল জলধারা আর নেই। ইছামতিতে বাঁধ দিয়ে কথিত প্রভাবশালীরা মৎস চাষ করে। নদীর বাঁক, নদীর খাড়ি বা নামেও নদী আছে। নদীর জলই কেবল নেই। জল নেইতো জলধারাও উধাও। সুখের কথা নদীর জলধারার আঁকাবাঁকা সীমানা এখনো টিকে আছে। নচেত শিরোনামে লিখতে হতো ‘এইখানে এক নদী ছিল’। মাইলের পর মাইল জলধারার ইছামতি নদীর তলদেশে সামান্য জলা’ধার। অপরিকল্পিত নদী শাসন বাঁধই ইছামতি বধ করেছে। সরকার উদ্যোগি হলে এখনো নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কাশিয়াখালি ইছামতির বাঁধে প্রয়োজন একাধিক স্লুইসগেট। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ প্রয়োজন, সাথে নদীর নব্যতাও দরকার। দেহ-মনে জীবনের সাথে জড়ানো নদীর এমন হাড়িয়ে যাওয়ার কারণ খোঁজার ইচ্ছে জাগে। একদিন ভোর বেলা নদীর পার ধরে বেড়িয়ে পরি ইছামতির জলধারার খোঁজে।

ইছামতি নদীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাঠকের জানা প্রয়োজন। শিথির মত একচিলতে ছোট্র ¯্রােতস্বিনী ইছামতি। সেই কোন কালে সেচের সুপেয় জলের প্রয়োজন মিটাতে ইছামতি খনন করা হয়েছিল। ঢাকা জেলার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলার বুক চীড়ে ইছামতির বয়ে চলা। আশির দশক পর্যন্তও রাজধানী ঢাকার সাথে এতদাঞ্চলের প্রধান যোগাযোগ পথ ছিল ইছামতি। এই নদী পথেই নবাবগঞ্জ এসেছেন বিশ্ব বরেন্য ব্যক্তিবর্গ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে একবার ইছামতির বুক গর্বিত করে লঞ্চযোগে নবাবগঞ্জ এসেছেন। মহাত্মা গান্ধি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গকেও ইছামতি নদী নিজ বক্ষে বহন করে নবাবগঞ্জ এনেছেন। মুলত পদ্মার মাওয়া ঘুরে ঢাকা যাবার রাস্তার দূরত্ব কমাতে ইছামতি নদী ব্যবহৃত হতো। নবাবগঞ্জ উপজেলার বান্দুরা থেকে ইছামতির দুইটি ধারা পদ্মার সাথে সংযুক্ত। একটি ধারা নবাবগঞ্জ উপজেলার কাশিয়াখালি এবং অপরটি দোহার উপজেলার কার্তিকপুর পদ্মায় সংযুক্ত। কাশিয়াখালি থেকে কেরানীগঞ্জ উপজেলার সৈয়দপুর এসে ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে। উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার। স্বাধীনতার পর পরই কার্তিকপুর বাঁধ দেওয়া হয়। কাশিয়াখালির ধারা খোলা থাকতেও নদীর নাব্যতা ছিল। ২০০১ সালে কাশিয়াখালি বাঁধ হওয়ার পর নদীর জলধারা নেই। নব্যতার প্রশ্নই উঠে না। নদীর তলদেশে দু’কুলে পায়ে চলার পথ। মাইলের পর মাইল নদী বছরের আট মাস শুকনা থাকে। অনেক স্থানে হাটুজল থাকে বটে। বর্তমান ইছামতির চরিত্র রবিন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মত। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাটুজল থাকে। পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি। দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।’ পরিতাপের বিষয় ইছামতি বৈশাখ বা ভাদ্র সব মাসেই হাটু জলের নদী।

উজানে বন্দুরা পর্যন্ত নদীর চেহারা মোটামোটি ঠিক আছে। যেটুকু পানি আছে জোয়ারের সময় তাতেই অল্প বিস্তর নৌযান চলাচল করে। বান্দুরা থেকে কার্তিকপুরমুখি ইছামতি অনেক পূর্বেই অস্তিত্ব হাড়িয়েছে। কাশিয়াখালির দিকে শাখাটির তবু সীমানা টিকে আছে। তাই সেদিকেই হাটা লাগাই। নতুন বন্দুরা সেতুর মাঝে দাড়িয়ে নদী বরাবর তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করি। উপর থেকে নদীর ক্ষীনতা আরো বেশী নজরে পরে। নৌকার খোলের মত খট্খটা নদীর ঢাল। নদীর ঢালে থোকা থোকা সবুজের আচ্ছাদন। বৃক্ষগুলির শিকড় জটা চুলের মত পাড়ে ঝুলে পড়েছে। নদীর ঢাল থেকে তলদেশে যে ছোট ছোট গুল্ম, জংলা ঝোপগাছ জোয়ারের পানিতে আরো তরতাজা । বুঝাই যায় কিছুদিন পূর্বেও নদীতে কোন জল ছিল না। সেতুর উপর থেকেই টলটলে পানির নীচে ডুবা ঘাস দেখা যায়। সেখানে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে নদীর পার ধরে আলালপুর, আগ্রাদী, মহেশপুর, নয়নশ্রী, মনিকান্দা, কাইনিয়াকান্দা, সুজাপুর, শিকাড়িপাড়া, সোনাবাজু, গরিবপুর, দাউদপুর, খানেপুর, বক্তারনগর, তুইতাল, রামনগর, বকচর, পাঞ্জিপহরী বাড়ৈইখালি হয়ে কাশিয়াখালি বেড়িবাঁধে উঠি। ছোট ছোট এসব গ্রামে এখনো যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লাগেনি। কিনতু বিদ্যুৎ, পিচ্ঢালা পথ এবং দালান-কোঠা নিয়ে আধুনিক চালচলনে কোন কমতি নেই। নদীকে কেন্দ্র করেই এসব গ্রামের গোড়াপত্তন। নদীর দুই পারে মানুষের বসতি। নদী পারেই হাট বাজার। নবাবগঞ্জবাজারসহ, কোমরগঞ্জ, বাগমারা, কলাকোপা, ধাপারি, গোবিন্দপুর, বান্দুরা, খানেপুর, দাউদপুর, তুইতাল, শিকারীপাড়া, কাশিয়াখালি এসব স্থানে নদীতীরে হাট বাজার । একসময় নদী পথেই পণ্য ও মানুষ যাতায়াত হতো। ঘরে ঘরে ছিল ছোট ছোট ডিঙি নৌকা। এক মাল্লাইয়া ছইয়া নাউ বান্দুরার খুব জনপ্রিয় একটি নৌকা। আমরা কেরাই নাউ নামে চিনি। বিশেষ করে খৃষ্টান নারীরা কেরাই করে বাজারে যাতায়াত করতো। এখন সবই অতিত। নদীর জলই থাকে না। যাতায়াতের প্রশ্নই আসে না। জাতি ধর্মে এখানে যে মেলবন্ধণ তা বিশ্বে বিরল বললেও কম বলা হবে। নতুন বান্দুরা ভাঙ্গা মসজিদ, তুইতাল বা গোল্লা গীর্জা, বান্দুরা বা গোবিন্দপুর হিন্দু মন্দির সবই ইছামতি নদীর তীরে। চৈত্র মাসে হিঁদুদের স্নান উৎসবও কিন্তু ইছামতিতে হতো। হবেই বা না কেন ! ইছামতির পানিতো গঙ্গারই পানি। দরীদ্র কামার, কুমার, ঋষির সাধ্য নেই খরচ করে গঙ্গাস্নানে যাবে। তাই কলাকোপা  স্নানঘাটাতেই পূন্যস্নানের কাজ তারা সেরে ফেলতো। গ্রামের মানুষ নদীর উপর কতটা যে নির্ভরশীল তা চোখে না দেখলে বুঝা মুশকিল। উপর থেকে দেখলে ক্যানভাস এমন হবে, নদীর দুই পারে জনবসতি, গ্রামের মাঝে পূর্ব-পশ্চিমে বহমান আঁকাবাঁকা নদী, গ্রামের উত্তরে ও দক্ষিণে ধানক্ষেত। আরও দক্ষিণে বিস্তর্ণ কোঠাবাড়ির বিল। নদী পারের জীবনে ফিরে আসি। বর্ষা আসি আসি করছে। মাত্র একটা বৃষ্টিতেই নদীতে কোমড় পানি। নতুন বান্দুরা হালদার পাড়া ঘাটে দেখলাম নারীরা জলের কিনারায় বসে কাপড় কাঁচে। কাপড় ধুয়ে শুকানোর বন্দোবস্তো হিসাবে নদীর কিনারে বাঁশের আড় পাতা। ছোট শিশুরা কোমড় পানির নদীতে ঝাপাঝাপি দাপাদাপি করেও কোন ক্লান্তি নেই। এক শিশুর মা সন্তানের নাম ধরে ডাকে, ‘গোবিন্দ বাপ এবার উঠ্ জর এলে রক্ষে নেই।’ একজন গৃহস্থ বাছুর আর গাভিটা নদীতে ঝাপিয়ে নিল। আলালপুর ঘাটে একজন নারীকে দেখলাম সিলভারের এক কলস পানি কাঁখে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। অবশ্য জানা হয়নি পানি কি কাজে লাগবে। জলের কিনারে কোন কোন জায়গায় রোয়া বুরো ধান। নতুন বন্দুরা হালদার পাড়ার শান্ত হালদার আর সুবল হালদারের বয়স ১২ থেকে ১৫ হবে। দুই ভাই নদীর হাটু জলে নেমে খুদি শামুক কুড়ায়। ছোট্র নৌকাটি হাতে টেনেই জলে হাটে। জানতে চাই, এক ঝাকা শামুক কি কাজে লাগবে। পাড়নের টোপ হিসাবে শামুকের ভিতরের নরম মাংসল অংশ ব্যবহার করে। পাড়নে টেংড়া, পুটি, সিং মাছ পাওয়া যায়। তবে ওরা আক্ষেপ করে বলে মাছ খুব একটা আর পাওয়া যায় না। বাজার থেকে মাছের শুন্য খাড়ি মাথায় বাড়ির দিকে ফিরছিলেন এক জেলে। হাটতে হাটতেই কথা হয় তার সাথে। জেলেদের জীবন জীবিকার একমাত্র মাধ্যম ইছামতি। ইছামতি শুকানোর কারণে অধিকাংশ জেলে নিজেদের পেশা ছেড়ে দিন মজুর বা রিক্সা ভ্যান চালায়। যে ক’মাস পানি থাকে ! প্রভাবসালীরা দখল করে মাছ চাষ করে। নদীতে জেলেদের কোন অধিকার নেই। নদীর জল শুকানোর সাথে পারের মানুষের জীবনে-যাপনের বন্ধনও আলগা হয়েছে। এখনো যেটুকু জল তাতেই একঘাটে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান সকলে মিলেমিশে কাজ করে। খারাপ লাগে মনিকান্দা যাওয়ার পর। মনিকান্দা একস্থানে নদীতে আড়াআড়ি বাঁশের বানা দেওয়া। নদীর ভাটিতে গরিবপুর গ্রামেও একই রকম বানা আছে। শিকারীপাড়ার চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এভাবে বানা দিয়ে মাছ চাষ করা হয়। সমিতির নাম দিয়ে মৎস অধিদপ্তর থেকে লিজ নেওয়া। উপজেলা প্রশাসনেরও অনুমতি দেখলাম। একটু অবাক হয়েছি বৈকি। এভাবে নদীতে বানার প্রতিবন্ধকতা দিয়ে মাছ চাষের অনুমতি দেওয়া কতটা যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। অবশ্য চেয়ারম্যান সাহেব জানালেন নদী পুনঃ খনন কাজ চলছে। তিনি অনেক কথাই জানালেন, বন্যা থেকে রক্ষার জন্য বেড়িবাধ হয়েছে। ফসলি জমি ভেসে যাওয়া থেকে হয়ত রক্ষা পেয়েছে। অথবা নদীর ভাঙন রোধ হয়েছে। তবে ইছামতির ক্ষতির পরিমানই বেশী। রিভার সাইডে (পদ্মার সাইডে) পানির স্তর দশ ফুট উঁচু হলেও কান্ট্রি সাইডে (ইছামতির সাইড) পানি থাকে না। জমিতে শুধুমাত্র ইরি ধান ছাড়া আর কোন ফসল জন্মে না। মাটির উর্বরতা নাই। পদ্মার পানির স্রোতের সাথে প্রতি বর্ষায় জমিতে পলি জমা হতো। ফসল হতো বেশী। বছরে তিন ফসল পাওয়া যেত। এখন জমির উর্বরতা নাই। পানিতে  স্রোত না থাকার কারনে ইছামতি নদীর জলাধারগুলো দুষিত। পানিতে গোসল করলে গায়ে খুঁজলি, পাচরা, চুলকানি, ডায়রিয়া, আমাশয় রোগ লেগেই থাকে। বেড়িবাধ করার সময় নদীতে নব্যতা ঠিক রাখার জন্য ছয়টি স্লুইসগেট থাকার কথা। কিন্তু শুধুমাত্র কৃষ্ণখালি একটি স্লুইস গেট তৈরী করা হয়। বর্ষার পানির তোরে তা যে কোন সময় ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। জরুরী ভিত্তিতে কাশিয়াখালিতে ইছামতি বাধে কমপক্ষে চারটি স্লুইসগেট দরকার। তাছাড়া বাধের স্থায়িত্ব ঠিক রাখতে হলে গোপালখালি, ঘোষাইল, কুঠরীতে আরও তিনটি স্øুইসগেট বানানো প্রয়োজন। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সারা বছরই নদীর নব্যতা কিছুটা হলেও থাকবে। পাশাপাশি ফসলি জমিতেও বছরের চার মাস প্রয়োজন মাফিক পানি থাকবে।

ইছামতির মাতা পদ্মার উৎসে ফিরে দেখি কেন এই নদীর পানি দেহমনের জন্য উপকারী। ডিসকভারী চ্যানেলের অনুসন্ধানী গবেষনায় দেখা গেছে গঙ্গার পানিতে বিশেষ অনুজীব বিদ্যমান। হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি। যেখানে গঙ্গার উৎপত্তি সেখানকার পানি দুধের মত সাদা। হিমশীতল বরফগলা জল পাথুরে পাহাড়ের গাঁ ঘষেমেজে সমতলে বহে। সমতলে স্রোতধারার সাথে মিশে পলি কণা। দিব্য দৃষ্টিতে পদ্মার জল ঘোলা মনে হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে পলির সাথে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিম্ব আকাড়ে কোটি কোটি অনুজীব বিদ্যমান। যা মানুষ ও প্রানীর দেহের জন্য উপকারী। গঙ্গা বা পদ্মার পানি খেলে পেটের পিড়া ভাল হয়। নিয়মিত স্নান করলে দেহে চর্মরোগ হয়না। এটাও পাওয়া গেছে দূষিত হলে নিজে নিজেই দূষণ মুক্ত হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে গঙ্গা নদীর। গঙ্গা বাংলাদেশের সীমানায় নাম পাল্টে পদ্মা হলেও এর চরিত্র পাল্টায়নি। পদ্মার জল যেখানে বহমান সেখানেই সৃষ্টি করেছে উর্বর শষ্যভুমি। পদ্মার মৎসকুল পৃথিবীর সেরা এবং সুস্বাদু হিসাবে পরিচিত। আর পদ্মার ইলিশ আবহমান বাংলার ঐতিহ্য। জাতীয় মাছের মর্যাদায় ভূষিত। এসবের অর্ন্তনিহিত তাৎপর্য হচ্ছে পদ্মার পানির বিশেষ গুণগত মান। প্রমত্ত্বা পদ্মার তীব্র জলধারা ইছামতির দু’কুল সুজলা সুফলা সবুজে রাঙিয়ে দেয়। কিন্তু বর্ষাকালে পদ্মার জলধারার সাথে ভারি বর্ষণের পানিতে নদীর কুল প্লাবিত হতো। তীব্র ¯্রােতের তোড়ে নদীর দুই কুলেই ভাঙন লাগে। যে কারনে নদী শাসনের প্রয়োজন হয়। অপরিকল্পিত বাঁধে নদী শাসন করতে গিয়ে নদীর অস্তিত্ব বিলিন।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদী বিধৌত পলিমাটি জমে বাংলাদেশের উর্বর ভূখন্ড সৃষ্টি। ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরের গোড়া পত্তন হয়েছিল নদী কেন্দ্রীক। একসময় নদী পথই ছিল মানুষ ও মালামাল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অদূরদর্শিতা ও সাধারন মানুষের অসচেতনতার কারনে স্বাধীনতার পরে দেশের নদ নদীর সংখ্যা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৭’শ নদীর প্রায় ২৪ হাজার ১’শ ৪০ বর্গকিলোমিটার নদী পথ রয়েছে। যেসব নদী এখনো বেঁচে আছে তাও দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রে বিলিন হওয়ার পথে। শহর, নগর ও শিল্পাঞ্চলের পাশ দিয়ে বাহিত নদীর পানি দূষিত। নদী আছে। পানিও আছে। কিন্তু দূষণের মাত্রা বেশী হওয়ায় পানি ব্যবহারতো দূরের কথা নদীর আশপাশে বসবাসও করা যায় না। ব্যক্তিস্বার্থে নদীতীর দখল ও ভরাট করে গড়া হচ্ছে ইমারত। পানির অপর নাম জীবন, যদি তা হয় বিশুদ্ধ পানি। মানুষ বা প্রাণী কূলের জীবন ধারনের জন্য যেমন বিশুদ্ধ পানি প্রয়োজন। তেমনি নদ-নদীর বেঁচে থাকাও নির্ভর করে বিশুদ্ধ পানির উপর। মানুষের নৃশংস ব্যবহারে জীবন্মৃত তেমনি এক অসহায় নদীর নাম ইছামতি। ইছামতির জলাধারা খোঁজতে গিয়ে যতই উজানে গিয়েছি ততই হতাশ হয়েছি। নদীর বুকে পানিশুন্যতার হাহাকার। ইছামতি পারের মানুষ নিভৃতে চোখের জলে বুক ভাসায়। এখনো বেঁচে আছে ইছামতির স্বপ্ন। এলাকাবাসী উদ্যোগী হয়েছে ইছামতি বাঁচাও আন্দোলনে। কাশিয়াখালি বাঁধে অন্ততঃ চারটি স্লুইসগেট হলে নাব্যতা ফিরে পাবে ইছামতি। বাঁচবে ইছামতি। এতে সারফেস ওয়াটার সেচে কৃষকের সুবিধা হবে। আবার প্রানবন্ত হবে ইছামতি পারের মানুষের জীবন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক