আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক যখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তখন রুশ প্রেসিডেন্টের চীন সফর বাড়তি গুরুত্ব পাচ্ছে। যদিও তাকে মূলত আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনি অনুষ্ঠানে। ইউক্রেন ইস্যুতে বিশ্ব রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আগেই পুতিনকে চিঠি দিয়েছিলেন শি জিনপিং। তবে ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে এই দুই নেতার মধ্যেকার আলোচনার বিষয়বস্তুর দিকে চোখ পুরো বিশ্বের।
আল-জাজিরার খবরে জানানো হয়েছে, এই সংকটময় সময়ে পুতিনের চীন সফর মূলত দুই দেশের মধ্যে থাকা শক্তিশালী ঐক্যের বার্তাই দিচ্ছে। এক টেলিভিশন বার্তায় শুক্রবার পুতিন বলেন, চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক মর্যাদাপূর্ণ এবং অভূতপূর্ব। তার পাশে থাকা চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, তাদের মধ্যেকার আলোচনা চীন ও রাশিয়ার সম্পর্কে নতুন জীবনীশক্তির মতো কাজ করবে।
ইউক্রেন সংকট ছাড়াও ব্যাবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করেন পুতিন ও শি জিনপিং। পুতিন জানান, রাশিয়া চীনের কাছে গ্যাস রপ্তানি বৃদ্ধিতে প্রস্তুত। এ জন্য দেশটির পূর্ব অংশ থেকে নতুন একটি পাইপলাইনের মাধ্যমে ১০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এর ফলে রাশিয়া থেকে চীনে গ্যাস রপ্তানির পরিমাণ বছরে ৪৮ বিলিয়ন কিউবিক মিটারে দাঁড়াবে। পুতিন আরও বলেন, তিনি দুই দেশের মধ্যেকার বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ২০০ বিলিয়ন ডলারে নিতে চান। ২০২১ সালে দুই দেশের মধ্যে ১৪০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়েছিল।
আল-জাজিরার সাংবাদিক ক্যাটরিনা ইউ বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে ন্যাটোর বিরুদ্ধে রাশিয়াকে শক্ত সমর্থন দিচ্ছে চীন। তবে এর মানে এই না যে ইউক্রেনের উপরে রাশিয়ার আক্রমণকে চীন স্বাগত জানাবে। কারণ ইউক্রেনের সঙ্গেও চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। দেশটির বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্পের বড় সহযোগী রাষ্ট্র ইউক্রেন। তাই চীন এ অঞ্চলে কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা চান না। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়া ও চীন কারোরই তেমন সুসম্পর্ক নেই। তাই ইউক্রেন ইস্যুতে যদি রাশিয়ার উপরে নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসে তাহলে চীন রাশিয়াকে এই নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় সহযোগিতা করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। এর আগে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া নিয়ে নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো যখন রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তখনও প্রেসিডেন্ট পুতিন চীনের দিকে তাকিয়েছিলেন। চীনও তখন রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেসময় বেইজিং শুধু তেল এবং গ্যাস কেনা নিয়েই মস্কোর সাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে। এটিই সে সময় রাশিয়াকে অর্থনৈতিক ভরাডুবি থেকে থেকে বাঁচিয়েছিল। রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল নিয়ে চীন অস্বস্তিতে পড়লেও সস্তায় এবং সহজ শর্তে রাশিয়ার জ্বালানি সম্পদ কেনার সুযোগ তারা তখন হাতছাড়া করেনি।
বিবিসির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রকে অভিন্ন শত্রু মনে করে চীন ও রাশিয়া। এই অভিন্ন শত্রুকে মোকাবেলার কৌশল হিসাবে ঐক্যের তাড়না থেকে ব্যবসা-অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক গত বছরগুলোতে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। চীন এখন রাশিয়ার তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান ক্রেতা, আধুনিক অস্ত্রের বড় ক্রেতা। রাশিয়ার রপ্তানি আয়ের ২৫ শতাংশ আসে চীন থেকে। গত বছর দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিমাণ ১৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যা ২০১৫ সালে ছিল মাত্র ৬৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সাল থেকে পাইপলাইন দিয়ে চীনে রাশিয়ার গ্যাস যাচ্ছে।
তবে শুধু সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার কারণে নয়, যুক্তরাষ্ট্রকে কোণঠাসা করতেও পুতিনকে সমর্থন দিচ্ছেন শি জিনপিং। ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ক্রিস মিলার বলেন, ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আপোষহীন অবস্থান দেখে চীন তাইওয়ান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে কঠিন অবস্থান নিয়েছে, সেটাকে বেইজিং একটি বার্তা হিসাবে দেখছে। চীন মনে করছে তাইওয়ান বা দক্ষিণ চীন সাগরের ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্র যে এমন কঠোর অবস্থান নেবে সেই বার্তা পাওয়া যাচ্ছে।
কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পর ১৯৯৬ সাল থেকেই চীন ও রাশিয়া একে অপরের কাছে আসতে শুরু করে। ওই বছরই তারা নিজেদের সীমান্ত সমস্যাগুলো সমাধান করে। তারপর ২০০১ সালে তারা একটি মৈত্রী চুক্তি করে। আস্তে আস্তে দুই দেশ কৌশলগত সম্পর্কের কিছু কাঠামো তৈরি করে ফেলেছে। নিজেদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দুই দেশ এখন অভিন্ন সুরে কথা বলছে। দুই দেশই এখন বুঝতে পারছে বিশ্ব ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য নিজেদের ঐক্যকে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।
